চৈত্র মাসের ২৯ তারিখ চাকমাদের বিজুর সূচনা পর্বের আয়োজন দিয়ে শুরু হয় বৈসাবি উৎসব।
বিজু: ফুল বিজু, মূল বিজু এবং গয্যাপয্যা, এই তিন পর্ব মিলে হয় চাকমাদের বিজুর আয়োজন। প্রতিবছরই খাগড়াছড়ির খবং পরিয়ার পাড়ায় আয়োজন করা হয় ফুল বিজুর।
ভোরবেলা থেকে ফুল হাতে নদীর পাড়ে আসবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা। বিজু ফুল, মাধবী, জবা, গাঁথা, রংগন, অলাকান্দসহ নানান বর্ণের ফুল সবুজ কলাপাতায় করে ভাসানো হবে নদীর জলে। পুরনো বছরের গ্লানি মুছে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতেই এই ঐতিহ্যবাহী আয়োজন।
নারীদের পরনে থাকে পিনন, থামি, গলায় মালা আর হাতে ফুল, গায়ে ধুতি-মাথায় ঐতিহ্যবাহী কাপড় বেঁধে পুরুষরাও ফুল ভাসাতে আসেন। ফুলের মালা গলায় দিয়ে বাবা-মায়ের হাত ধরে আসে শিশুরা।
ফুল বিজু মূলত চাকমাদের উৎসব হলেও, সবার অংশগ্রহণে তা সার্বজনীন রূপ নেয়। আদিবাসী পল্লীতে গৃহসজ্জার আয়োজন চলে ।বাড়িতে রান্না হয় নানান পদের বাহারি সবজির পাঁচন।
সঙ্গে থাকে বিনি পিঠা, স্যানা পিঠা, বড় পিঠা ইত্যাদিসহ আরও নানাপদের পিঠা।
বৈসু: কৃষিনির্ভর গোষ্ঠি ত্রিপুরাদের বৈসুর অন্যতম আকর্ষণ গরিয়া নৃত্য। ত্রিপুরাব্দের তালাং মাসে তিন দিনব্যাপী চলে বৈসুর নানা আয়োজন।
এরমধ্যে ২৯ চৈত্র বৈসুমা, ৩০ চৈত্র বৈসুমা ও ০১ বৈশাখ বিসি কাতাল বা আতাদা। বৈসু উদযাপনে ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম আর্কষণ গরিয়া বা গরয়া নৃত্য।
আদিকাল থেকে ত্রিপুরা কৃষি নির্ভর জীবনের সাথে নিবিড় ভাবে মিশে আছে গরিয়া নৃত্য। কৃষিই এখানকার প্রাণ। তাই জুম ভিত্তিক কৃষিকাজ যাতে সমৃদ্ধ হয় রোগবালাইয়ের আক্রমণ থেকে ফসল যাতে রক্ষা পায় এজন্য প্রার্থণা করা হয় গরিয়া নৃত্যে। ত্রিপুরাব্দের তালাং মাসে তিন দিনব্যাপী বৈসু বা বৈসুক উদযাপিত হয়।
এরমধ্যে ২৯ চৈত্র বৈসুমা, ৩০ চৈত্র বৈসুমা ও ০১ বৈশাখ বিসি কাতাল বা আতাদা। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস- ভগবানের আরেক নাম গরয়া। দেবতা গরয়াকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যেই এই নৃত্য পরিবেশিত হয় যার মধ্যে মানব জীবনের নানা ক্রিয়াকলাপ ফুটে উঠে বলে বিশ্বাস করেন তারা।
সর্বমোট ২২টি মুদ্রায় পরিবেশিত হয় এই নৃত্য। যেমন, জুমে ধান রোপণ, ছড়ার মাছ শিকার, হাতে হাত ধরে চলা, দেবদেবীর প্রার্থণা ইত্যাদি। গরিয়া নৃত্যে অংশগ্রহণকারীদের খেরেবাই নামে ডাকা হয়। রীতি অনুযায়ী গরিয়া নৃত্যে অংশগ্রহণকারীকে টানা তিন বার অংশ নিতে হবে। যদি কোনো খেরেবাই টানা তিনবার অংশ নিতে না পারে তবে তাকে গরয়া দেবের পুজো করতে হবে।
নারীদের গরিয়া নৃত্যে অংশ নেওয়ার রেওয়াজ থাকলেও বর্তমানে নারী–পুরুষ উভয়েরই সমান অংশগ্রহণ রয়েছে। বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে খেরেবাইরা গরিয়া নৃত্য পরিবেশন করে।
খেরেবাই কোন বাড়ির উঠানে প্রবেশ করলে তার দল নির্দিষ্ট কিছু সংকেতিক আওয়াজের মাধ্যমে গরিয়া দলের আগমনী সংবাদ দেয়। এরপর চলে গরিয়াদের পরিবেশনা।
আশপাশের পাড়া প্রতিবেশীরা গৃহস্থের বাড়ির উঠানে বসে গরিয়া পরিবেশনা উপভোগ করে। এসময় দলের একজন ত্রিশুলের মতো লাঠির মাথায় স্থাপিত গরিয়া দেবের বহন করে, তার নাম অচাই, আর তার পিছনে থাকে দেওরাই। খাগড়াছড়িতে য়ামুক নামক একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন দল প্রতিবছর গরিয়া নৃত্যের আয়োজন করে।
সাংগ্রাই: প্রতিবছর এপ্রিলের ১৩ থেকে ১৫ তারিখে মারমাদের বর্ষপঞ্জিকা “ম্রাইমা সাক্রঃয়”য়ের সঙ্গে মিল রেখে পালিত হয় এই উৎসব “ম্রাইমা সাক্রঃয়” এর পুরনো বছরের শেষের দুই দিন আর নতুন বছরের প্রথম দিনসহ মোট তিনদিন কে মারমারা সাংগ্রাই হিসেবে পালন করে থাকে।
১৩ তারিখের সকালে পাংছোয়াই (ফুল সাংগ্রাই), ১৪ তারিখে প্রধান সাংগ্রাই আর ১৫ তারিখে পানি খেলার সঙ্গে মারমাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোও অনুষ্ঠিত হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে নতুন জুম চাষের মৌসুমের শুরুও সাংগ্রাই’য়ের পরেই হয়ে থাকে। শুধু জুম চাষই নয় মারমারা মাঘী পূর্ণিমার পর থেকে সাংগ্রাইয়ের আগ পর্যন্ত নতুন বিয়ে করে না অর্থাৎ সাংগ্রাইকে মারমারা নতুন বছরের শুরুসহ পুরনো সব জিনিসকে ঝেরে ফেলে নতুন করে শুরু করাকেই বোঝায়।
পাংছোয়াই (ফুল সাংগ্রাই): ‘পাংছোয়াই’য়ের অর্থ ফুল ছেঁড়ার দিন যা সাধারণত ১২ এপ্রিলের রাতেই হয়ে থাকে। পাহাড়ে অনেক ফুল থাকলেও কিছু নির্দিষ্ট ফুল দিয়েই বাড়িঘরগুলো সাজানো হয়। এরমধ্যে ‘সাংগ্রাই পাং’ নামে সাদা রংয়ের ফুলটি সব থেকে প্রিয়।
ফুল ছেঁড়ার কাজটি মূলত মারমা তরুণ-তরুণীরাই করে থাকেন। একে কেন্দ্র করে মারমা তরুণ-তরুণীরা আগের রাতে সারারাত জেগে পিঠা বানায়, ঐতিহ্যবাহী খেলার ব্যবস্থা হয়, নাচ-গান ইত্যাদি চলতে থাকে। এরপরে আলো ফোটার আগেই একদম ভোরে দলে দলে পাহাড়ে গিয়ে ‘সাংগ্রাই পাং’ তুলে নিয়ে মায়ের হাতে তুলে দেয়।
মারমা ছোট ছেলেমেয়েদেরও এই পাংছোয়াই নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ থাকে। তবে মারমাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা ছোট ছেলেমেয়েদেরকে সবসময় মারমা ডাইনী ‘ফ্রুজুমা’য়ের ভয় দেখিয়ে রাখে। এমনকি এই ‘পাংছোয়াই’ নিয়ে অনেক প্রচলিত গল্পও আছে।
তার মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় হল ফ্রুজুমা’র ফাঁদে আটকে যাওয়া।
ফ্রুজুমা ‘সাংগ্রাই পাং’য়ের লোভ দেখিয়ে কোনো একজনকে দলছুট করে এমন গভীর জঙ্গলে নিয়ে যাবে যে তা থেকে দিনের আলো ফোটার আগে কখনই আর মুক্তি পাওয়া যাবে না। কারণ ফাঁদে পড়ার পর যেখানেই যাবে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গলই পাবে।
আর ‘সাংগ্রাই পাং’ সাধারণত সকালের আলো ফোটার আগেই ছিঁড়তে হয়। এই কিচ্ছা দিয়েই মারমা মা-বাবারা তাদের সন্তানদের আগলে রাখে।
১৩ তারিখেই ‘সাংগ্রাই জিই’ নামে অনেক বড় হাট বসে যেখানে সাংগ্রাইয়ের জন্য সকল প্রয়োজনীয় জিনিসই পাওয়া যায়।
প্রধান সাংগ্রাই বর্তমানে ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুসারে এপ্রিলের ১৪ তারিখেই পালন করা হয়। মারমা গৃহিণীরা ভালো ভালো ভালো খাবার পিঠা নিয়ে বিহারে যায় যাকে “ছোয়াঈ” বলে।
শুধু নিজেদের বিহার ছাড়াও আশপাশের বিহারেও ‘ছোয়াঈ’ পাঠানো হয়। ‘ছোয়াঈ’ শুধু ভগবানের উদ্দেশ্যে নয়, নিজেদের আত্মিয়দের মাঝে যারা উপোসথ শীল পালন করে তাদের উদ্দেশ্যেও পাঠানো হয়।
আর মারমা তরুণ-তরুণীরা দল বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠদের স্নান করাতে যায়। প্রত্যেক পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা গোসল শেষে তাদেরকে সাংগ্রাই এর সেলামি ও আশির্বাদ দেন।
প্রধান সাংগ্রাই’তে বিহারে যে ভগবান বুদ্ধ আছে তাদেরকে পবিত্র পানি দিয়ে গোসল করানো হয়। বুদ্ধকে স্নানকরানো পানি পান করেন মারমারা কারণ তাদের বিশ্বাস এই বুদ্ধ স্নানস্কৃত পানি তাদের শরীরে সকল রোগ মুক্তি ঘটাবে।
প্রধান সাংগ্রাইয়ের পরেই বিভিন্ন জায়গায় ‘ড়িলংপোয়ে’য়ের আয়োজন করা হয়।
দূর-দূরান্ত থেকে আসা মারমা তরুণ-তরুণীরা ‘সাংগ্রাই মা ঞিঞীই ঞাঞাই, রিগ জাং কাঈ পা মে’ গান গেয়ে দলে দলে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে থাকেন। মারমা রাজা কিংবা মারমাদের মৌজা প্রধান অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।
আনুষ্ঠানিকভাবে পানি খেলা ছাড়াও ওইদিন সবার হাতেই একটা করে পানির বোতল থাকে। যার যাকে মন চায় সে তাকেই পানি ছিটাতে পারবে, এতে কেউ কোনো আপত্তি করে না বরং এটিকে আর্শিবাদ আর শুভ লক্ষণের প্রতীক হিসেবে ধরে নেয়।
পানি খেলার পরপর মারমাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ছেলেদের বলি খেলা, মেয়েদের দড়ি টানাটানি খেলা হয়ে থাকে। আর সব থেকে আকর্ষণ হল ছেলেদের বাশঁ ওঠানো (তং তাং) খেলা।
এতে ২৫ ফুটের বেশি লম্বা বাঁশ থাকে যার একদম শীর্ষে একটি বড় পরিমাণের টাকা থাকে। একজনের কাঁধে আরেকজন উঠে শীর্ষের টাকাটা নিতে হবে।
প্রায় পাঁচজন হলেই টাকার নাগাল পাওয়া যায়। যে দল আগে নিতে পারবে সেই দল সেই টাকা পেয়ে যাবে। তবে খুব একটা সহজ নয়, কারণ বাঁশের উপরে তেল থাকে।
তাই যতই বাঁশ নাড়ানো হোক না কেনো ততই উপর থেকে তেল পড়ে বাঁশ পিচ্ছিল করতে থাকে।
দুপুরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় যেখানে মারমাদের ঐতিহ্যগুলোকে নানাভাবে তুলে ধরা হয়। সাংগ্রাই নৃত্য-সহ আরও নানান ধরনের নৃত্য, মারমা গান পরিবেশন করা হয়।