ঢাকা বৃহস্পতিবার
২১ জানুয়ারীজানুয়ারী ২০২৪
০৫ জুন ২০২৪

বোকা বিনিয়োগকারী


নিউজ ডেস্ক
72

প্রকাশিত: ২২ মার্চ ২০১৮
বোকা বিনিয়োগকারী



শওকত হোসেন : অর্থকে প্রায়ই ব্যবসার ভিলেন হিসেবে দাঁড় করানো হয়। কোনো উদ্যোক্তার ব্যবসায় লাল বাতি জ্বললে অবধারিতভাবে তিনি অর্থের দুষ্প্রাপ্যতাকে দুষবেন। ব্যবসার জন্য, সেটা শুরুতে বা চলমান অবস্থায় হোক, অর্থ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেক কিছু আছে, যার অভাবেও ব্যবসা বন্ধ হতে পারে। অনেকে হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। মৃত্যুর আরো বহুবিধ কারণ আছে। সব মৃত্যুতেই কিন্তু হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়। কিন্তু ব্যবসা বন্ধ হলে অর্থের স্বল্পতা দেখা দেয়। তার মানে অর্থের স্বল্পতাই ব্যবসা বন্ধ হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। ব্যবসা বন্ধ হওয়ার বহু কারণ আছে। অর্থের অভাব সেই বহু কারণের একটি মাত্র। ব্যবসার প্রারম্ভিক পুঁজি কিন্তু উদ্যোক্তার কাছ থেকে আসাই বাঞ্ছনীয়। প্রথমে তিনি ব্যবসার আইডিয়া ধারণ করবেন। সেটা লালন-পালন করবেন। নাড়াচাড়া করবেন। অন্যদের সঙ্গে আলাপ করবেন। সম্ভাব্য ক্রেতাদের বাজিয়ে দেখবেন। মা যেমন গর্ভজাত শিশুর দেখভাল করেন, তেমনিভাবে হবু উদ্যোক্তা তার আইডিয়ার যত্ন নেবেন। মা যেমন অনাগত শিশুর পৃথিবীতে আসার আগেই তার দিনযাপনের সুবিধার্থে ছোট ছোট জামা বা কাঁথা সেলাই করেন, উদ্যোক্তাকেও তার আইডিয়া বাস্তবায়নের জন্য আগাম প্রস্তুতি নিতে হয়। বাজার সম্পর্কে খোঁজখবর নেন, প্রতিযোগী আছে কিনা, তারা কেমন করছেন, কাঁচামাল বা মেশিন কোথায় পাওয়া যায় ইত্যাদি তত্ত্বতালাশ করেন। অনেকে টাকা-পয়সা জমাতে শুরু করেন কিংবা জোগাড়যন্ত্র করার সুলুক সন্ধান করেন। একবারে ঝাড়া হাত-পা নিয়ে ব্যবসায় নেমে, অন্যের ঘাড়ে চড়ে বেশিদূর এগোনো সম্ভব নয়। অনেকে তাই ছাত্রাবস্থায় টিফিনের টাকা জমিয়ে, কেউ যানবাহনের ভাড়ার টাকা বাঁচিয়ে, কেউ কৃচ্ছ্রসাধন বা টিউশনি করে টাকা জমান। উদ্দেশ্য ব্যবসার পুঁজি জোগান দেয়া। আজকের অনেক সফল উদ্যোক্তা ১০ বা ১৫ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন, যা এখন কয়েক কোটি টাকার সম্পদে পরিণত হয়েছে। নিজের পুঁজি খাটিয়ে কিছুটা এগোলে হাত পাততে হয় আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের কাছে। প্রথমেই আসে মা-বাবা, ভাই-বোন। ব্যবসা তখনো আঁতুড় ঘরে। কোনো প্রতিষ্ঠান উদ্যোক্তাকে— যদি না তিনি কেউকেটা হন— অর্থায়ন করবে না। কেউকেটা বলতে তার পারিবারিক সমৃদ্ধি বা পরিচয় বোঝায়। অথবা তার যদি কোনো পারিবারিক ব্যবসা থাকে। সেক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান তো ওই উদ্যোক্তাকে অর্থায়ন করছে না, করছে তার পরিবার বা পারিবারিক ব্যবসাকে। মা-বাবা বা আত্মীয়স্বজন উদ্যোক্তাকে অর্থায়ন করেন তার ব্যবসার গুণাগুণ বিচার করে নয়, আবেগের কারণে। ছেলে বা মেয়ে চাইছে, তাই টাকাটা দেই। সেক্ষেত্রেও উদ্যোক্তাকে মা-বাবা বা আত্মীয়ের কাছে ‘পিচ’ করতে হয়। বলতে হয়, টাকা দিয়ে কী করবেন, কেন করবেন, সঙ্গে আর কে বা কে কে আছে, কবে টাকা ফেরত দেবেন ইত্যাদি। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও চাহিবামাত্রই যে মা-বাবা বা আত্মীয়রা টাকা দেবেন তা কিন্তু নয়। এ ব্যবসা চলবে না বা তোর দ্বারা ব্যবসা হবে না বলে প্রত্যাখ্যানও করতে পারেন। কিংবা প্রার্থিত অংকের চেয়ে কম দিতে পারেন। আবার টাকা না থাকা সত্ত্বেও মায়ের গহনা বন্ধক রেখে টাকা দেয়ার উদাহরণও আছে। চট্টগ্রামে এক ব্যবসায়ীকে দেখেছিলাম ছেলেকে আলাদা ব্যবসা ধরিয়ে দিয়েছেন। প্রাথমিক পুঁজি দেয়ার পর ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমি তখন একটি ব্যাংকের এসএমই শাখার প্রধান। ফিল্ড ভিজিটে তার সঙ্গে যখন দেখা, তার চিন্তাধারা শুনে চমত্কৃত হয়েছিলাম। উদ্যোক্তা মানে তার সন্তানকে একটু বোকা বোকা লাগছিল আমার। ব্যবসায়ী বললেন, ‘আমি ছেলেকে টাকা দিতে পারি। কিন্তু দেব না। ব্যাংকের থেকে ঋণ নিলে সে চাপে থাকবে। ব্যবসা ভালো করতে বাধ্য হবে।’ ছেলের দুর্বলতা তিনি নিশ্চয় বুঝেছিলেন। তাই তাকে ‘সহজ’ টাকা না দিয়ে ‘চাপযুক্ত টাকা’র ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এ ধরনের অর্থায়নকারীদের বলে এফঅ্যান্ডএফ বা ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলি। অনেকে বলেন, ব্যবসার প্রাথমিক অর্থ আসে দুটি নয়, তিনটি ‘এফ’ থেকে। তৃতীয় ‘এফ’ হলো ফুল বা বোকা। অর্থাৎ ফ্রেন্ডস ফ্যামিলি অ্যান্ড ফুলস। এ বোকা বিনিয়োগকারীরা আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব নন। উদ্যোক্তাকে এদের কাছে ‘পিচ’ বা প্রেজেন্টেশন দিতে হয়। উদ্যোক্তা বা হবু উদ্যোক্তার প্রস্তাবনা পছন্দ হলে তারা খোঁজখবর নেন। বিচার-বিশ্লেষণ করেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বিনিয়োগ করেন। এরাই বোকা বিনিয়োগকারী। কেতাবী ভাষায় এদের বলে অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর বা দেবদূত বিনিয়োগকারী। একজন অপরীক্ষিত যুবক বা যুবতীর উদ্ভট কিছু আইডিয়া শুনে বিষয়জ্ঞানসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি বিনিয়োগ করার কথা নয়। তাই সাধারণ লোকজন তাদের বোকা হিসেবে বিবেচনা করে। স্বভাবতই উদ্যোক্তার কাছে তাদের আগমন ফেরেশতার মতো। অকল্পনীয়। অবিশ্বাস্য। তাই তাদের অ্যাঞ্জেল বা দেবদূত নামকরণ। অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর বলতে লন্ডনের নাটকপাড়া ব্রডওয়ের বিনিয়োগকারীদের বোঝাত। এখন অবশ্য যেকোনো স্টার্টআপে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীকে অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর বলে। তাদের অর্থ নয়, উদ্দেশ্যই মুখ্য: অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টররা অর্থের পেছনে ছোটেন না। অর্থ তাদের মূল চালিকা শক্তি বা অনুপ্রেরণা হলে অন্য কোনো নিশ্চিত লাভজনক প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারতেন। অনেকের কাছে নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করা আনন্দজনক। অনেকে তরুণদের সঙ্গে কাজ করে মজা পান। অনেকে একটি উদ্যোগের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গী হতে চান। ভাগ্যিস পৃথিবীর সব মানুষের মোটিভেশন বা অনুপ্রেরণা একই জিনিস নয়। তাহলে হবু উদ্যোক্তারা বিনিয়োগকারী খুঁজে পেতেন না। অনেকে মনে করেন, অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টররা বিশাল ধনী। প্রচলিত এ ধারণা ভুল। অনেক অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরের বার্ষিক আয় ৩০-৪০ লাখ টাকা। তাদের প্রিয় সংখ্যা ২ লাখ থেকে ১০ লাখ: অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টররা বড় অংকের টাকা বিনিয়োগ করেন না। ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেন। তবে ১, ২ বা ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগের আধিক্য বেশি। বিনিময়ে তারা নতুন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার নেন। কেউ আবার পরিবর্তনশীল বন্ড আকারেও বিনিয়োগ করেন। অর্থাৎ টাকাটা ঋণ হিসেবে দেন কিন্তু কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেই ঋণকে শেয়ারে রূপান্তর করা যাবে। অনেকের অসৎ উদ্দেশ্য থাকে: অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর সবাই যে সৎ বা ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে আসেন তা নয়। অনেকে অসৎ উদ্দেশ্য বা ধান্ধা নিয়ে এগিয়ে যান। ভাবেন উদ্যোক্তারা তরুণ। এতটা বৈষয়িক এখনো হয়নি। তাই তাদের ঠকানো অনেক সহজ। একটা বড় গ্রুপের কথা জানি, যারা নবীন উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন করেছিল। পরে উদ্যোক্তাদের সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে তাদের সই স্বাক্ষর নিয়ে নতুন কোম্পানির নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেন উদ্যোক্তাদের অজ্ঞাতে। সেই ঋণ অনাদায়ী হলো। ব্যাংক আদায়ের জন্য হামলে পড়ল। বড় গ্রুপ তখন গা-ঢাকা দিল। স্বভাবত নতুন উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেল। অনেক অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর কৃতিত্ব ফলাতে আসে। কথায় কথায় নতুন উদ্যোক্তাদের ভুল ধরে। নিজেকে ‘বড়’ জাহির করাই আসল উদ্দেশ্য। এ ধরনের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে দূরে থাকা উচিত। টাকাই সব নয়, বিনিয়োগকারীর সঙ্গে বনিবনা হবে কিনা, ভেবে দেখা উচিত। কথা না বলে দেখাও: অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরের কাছ থেকে টাকা নেয়ার আগে তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে। তারা কী ধরনের প্রকল্পে অর্থায়ন করেন, কী দেখতে চান, কেন বিনিয়োগ করেন, আগে কোন কোন উদ্যোগে বিনিয়োগ করেছেন, তা জেনে নিতে হবে। বিনিয়োগকারী প্রকল্পের ব্যাপারে উদ্যোক্তার অঙ্গীকার, ভালোবাসা ও জ্ঞান জানতে ও বুঝতে আগ্রহী। উদ্যোক্তার সততার ব্যাপারে যেন কোনো সন্দেহের উদ্রেক না হয়। প্রকল্পটি কোন সমস্যার সমাধান করবে, সেই সমস্যা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সমাজে বা দেশে তার ব্যাপ্তি কত, তা জানা দরকার। বিনিয়োগকারী একটি সুস্পষ্ট ব্যবসা পরিকল্পনা দেখতে চাইবেন। বিক্রয়ের নিদর্শন যৎসামান্য হোক, খুব কাজে দেবে। দারুণ কোনো প্রযুক্তি বা মেধাস্বত্ব তাকে উদ্বেলিত করতে পারে। উদ্যোগের ন্যায্যমূল্য ও যৌক্তিক শর্ত অর্থায়ন পেতে সহায়ক হবে। উদ্যোগ বড় হলে আরো টাকার প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা আছে কিনা, সে ব্যাপারে বিনিয়োগকারী নিশ্চিত হতে চাইবেন। নিজস্ব তহবিল: অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরের পরের ধাপে আসে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল। তারা বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা তুলে সেই টাকা স্টার্টআপে বিনিয়োগ করে। ভেঞ্চার ক্যাপিটালের টাকা অন্যের, তারা শুধু তহবিল ব্যবস্থাপনা করে। পক্ষান্তরে অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরের টাকা বিনিয়োগকারীর নিজের। টাকার অংক তাই কম হয়। উদ্যোগের প্রতি তিনি অনেক বেশি আন্তরিক ও যত্নশীল হন। প্রেক্ষিত বাংলাদেশ: আমাদের দেশেও অনেক অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর আছেন, যারা নীরবে নিভৃতে কাজ করছেন। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিতে কাজ করার সুবাদে আমরা তাদের অস্তিত্ব টের পাই নতুবা হয়তো জানতেই পারতাম না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা প্রচার-প্রচারণা চান না। ভেঞ্চার ক্যাপিটালের জন্য অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা উদ্যোগটিকে নাজুক অবস্থা থেকে তুলে এনে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের বিনিয়োগের উপযোগী পর্যায়ে নিয়ে আসেন। আবার ভেঞ্চার ক্যাপিটালের মাধ্যমে অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর তার ‘একজিট’ বা উদ্যোগ থেকে প্রস্থানের সুযোগ পান। অর্থাৎ দুজন দুজনের পরিপূরক। নাশিত ইসলাম চালডালসহ ১২টি উদ্যোগে, আসিফ রহমান থার্ড বেলসহ সাতটি উদ্যোগে, তানভীর আলী চালডাল, ব্যাকপ্যাক, জিঅ্যান্ডআরসহ ২২টি উদ্যোগে বিনিয়োগ করেছেন। তাদের অনেক উদ্যোগ থেকে তার একজিট বা প্রস্থান নিয়েছেন বেশ ভালো লাভ নিয়ে। আমাদের দেশে উদ্যোক্তা ও অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরের মধ্যে যোগসূত্র বা নেটওয়ার্কের ব্যবস্থা নেই। অনেক অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর ভালো উদ্যোগ খোঁজেন, পান না। আবার অনেক ভালো উদ্যোক্তা জানেন না কার কাছে, কোথায় যেতে হবে। ভারতসহ অনেক দেশে অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরদের নেটওয়ার্ক আছে। সেখানে নিয়মিত পিচিং বা প্রকল্প উপস্থাপনার ব্যবস্থা নেয়া হয়। উদ্যোক্তারা তাদের আইডিয়া বা প্রকল্প সম্পর্কে বলেন। অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টররা সেখানে উপস্থিত থেকে তাদের কথা শোনেন। প্রশ্ন করেন। পছন্দ হলে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। আমাদের দেশেও সে রকম নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন; হবু উদ্যোক্তাদের হাত ধরে সূর্যের আলোয় আনার জন্য।

আরও পড়ুন:

বিষয়: