জোরপূর্বক বিক্রির আতঙ্কে এখন বিনিয়োগকারীরা
নিউজ ডেস্ক
133
প্রকাশিত: ২৩ মে ২০২২
শেয়ারবাজারের একজন বিনিয়োগকারী ইসলাম। গাজীপুরের এ বাসিন্দা বেসরকারি দুটি ব্যাংকের সহযোগী ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে লেনদেন করেন। ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর পোর্টফোলিও ভ্যালু বা শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৬০ লাখ টাকা। গতকাল রোববার দিন শেষে ওই শেয়ারের বাজারমূল্য নেমে এসেছে সাড়ে ৬ লাখ টাকায়। কান্নাজড়ানো গলায় গতকাল বিনিয়োগকারী বলেন, ‘আমাদের বাঁচান, আমরা শেষ।’
ইসলাম বলেন, ‘কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকার আমাদের ক্ষতি, কান্না দেখছে না। এক নিয়ন্ত্রক সংস্থা আরেক নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। আর তাদের দ্বন্দ্বে পিষে মরছি আমরা। কোথায় গিয়ে, কার কাছে সাহায্য চাইব, বুঝতে না পেরে আপনাদের কাছে আকুতি জানাচ্ছি।
আপনারা কিছু করেন প্লিজ।’ পড়ালেখা শেষে চাকরি না পেয়ে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বাবার পেনশনের টাকায় এ বাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। কিন্তু এখন সব হারিয়ে দিশাহারা তিনি। এদিন দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১১৬ পয়েন্ট বা পৌনে ২ শতাংশ কমেছে। লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৯১ শতাংশ বা ৩৪৫টিরই দাম কমেছে। দাম বেড়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ বা ২১টির। অপরিবর্তিত ছিল সাড়ে ৩ শতাংশ বা ১৩টির।
গত কয়েক দিনের ভয়াবহ এ দরপতনে বেশির ভাগ শেয়ার ফোর্সড সেল বা জোরপূর্বক বিক্রির আওতায় পড়েছে। তাতেই নিজের পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব তিনি। কারণ, নিজের ৪০ লাখ টাকার পুঁজির বিপরীতে ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। সেই ঋণ আদায়ে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান তাঁর বেশ কিছু শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন।
শুধু ইসলাম, তাঁর মতো লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রির আওতায় পড়েছে। তাতে এসব বিনিয়োগকারী তাঁদের সব পুঁজি হারান। তবে যাঁরা ঋণ ছাড়া বিনিয়োগ করছেন, তাঁরা সব পুঁজি না হারালেও বড় অঙ্কের লোকসানে পড়েছেন। কারণ, ঈদের আগে থেকেই বাজারে মন্দাভাব চলছিল। সবাই আশায় ছিলেন ঈদের পর বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টো।
তার মধ্যে গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বড় ধরনের দরপতন চলছে। টানা এ পতন ঠেকাতে গতকাল লেনদেন শেষে শেয়ারের বিপরীতে ঋণসীমা বাড়িয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এখন থেকে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে নিজের ১০০ টাকার বিপরীতে ১০০ টাকা (১ অনুপাত ১) ঋণ পাবেন। বাজারে তারল্য সরবরাহ বাড়াতে এ উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ কার্যদিবসে এ বাজারের প্রধান সূচকটি ৫৫৫ পয়েন্ট বা সোয়া ৮ শতাংশ কমেছে। ৯ মে ডিএসইএক্স সূচকটি ছিল ৬ হাজার ৬৯৮ পয়েন্টে। গতকাল দিন শেষে এ সূচকটি নেমে এসেছে ৬ হাজার ১৪৩ পয়েন্টে। বাজারের এ পতনের জন্য পণ্যবাজারের অস্থিরতা ও মুদ্রাবাজারের ডলার-সংকটের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যকার সমন্বয়হীনতা ও মতানৈক্যকে বড় কারণ বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা।
একাধিক সাধারণ বিনিয়োগকারী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। আর এ সমন্বয়হীনতায় ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ মানুষ তথা বিনিয়োগকারীরা।
এদিকে গত কয়েক দিনের বড় ধরনের দরপতনের পর গতকাল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, বৈঠকে শুধু শেয়ারবাজার নয়, মুদ্রাবাজার, ডলার–বাজারসহ সব বাজার নিয়েই আলোচনা হয়েছে।
শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের সব শেয়ারবাজারের অবস্থা একটু খারাপ হয়েছে। আমাদের এখানেও তাই হয়েছে। তবে শেয়ারবাজারের যাতে ভালো হয়, সে জন্য আগামী বাজেটে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
বাজারসংশ্লিষ্ট একাধিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ কারণে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। আবার দাম অনেক কমে যাওয়ায় জোরপূর্বক বিক্রির পরিমাণও বেড়েছে। বিক্রির চাপ বাড়ায় বাজারে ক্রেতার সংকট দেখা দিয়েছে।
স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিডিবিএলের হিসাব অনুযায়ী, গত ৮ কার্যদিবসে ১৫ হাজার বিনিয়োগকারী তাঁদের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। তাতে শেয়ারবাজারে শেয়ারশূন্য বিও হিসাবের সংখ্যা গতকাল দিন শেষে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৯১ হাজার ৭২৫। ৯ মে এ সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭১৯।
বাজারের এ অবস্থায় করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বাজার এখন এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে। এভাবে পতন হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্যানিক সেল বা ভয়ে শেয়ার বিক্রি বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় যেভাবেই হোক, বিনিয়োগকারীদের ভয় দূর করে বাজারের প্রতি তাঁদের আস্থা ফেরাতে হবে।
ইতিমধ্যে বাজারে বেশ ভালো কারেকশন হয়ে গেছে। তবে বিএসইসির এ সাবেক চেয়ারম্যান মনে করেন, নানা কারণে বাজার তার নিজস্ব গতি হারিয়েছে। বারবার তৃতীয় পক্ষকে বিনিয়োগে এনে বাজারকে টেনে তোলা হয়েছে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়, কিছুদিন সূচক ওঠার পর আবার পতন শুরু হয়। বাজারে এখনো নানা ধরনের কারসাজির ঘটনা ঘটছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত এসব কারসাজি রোধে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তাতে বাজারের প্রতি আস্থা বাড়বে বিনিয়োগকারীদের।
আরও পড়ুন:
মার্কেট টাইমস সম্পর্কিত আরও
দিনভর উত্থান দেখিয়ে ঈদের ছুটিতে শেয়ারবাজার
১৩ জুন ২০২৪
সূচক বাড়লেও লেনদেন কমেছে শেয়ারবাজারে
১২ জুন ২০২৪
তিন শতাধিক কোম্পানির দরপতনেও বেড়েছে লেনদেন
১১ জুন ২০২৪
দেড় ঘণ্টায় প্রধান সূচক কমলো ৭২ পয়েন্ট
১০ জুন ২০২৪
লোকসানে ১১ খাতের বিনিয়োগকারীরা
০৮ জুন ২০২৪
সূচকের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় ৩৮১ কোটি টাকার লেনদেন
০৫ জুন ২০২৪