১৯৯৯ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালে এজবাস্টনে মুখোমুখি হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া। এবারের মতোই নাটকীয়তার অনেক ধাপ পেরিয়ে সেই ম্যাচ হয়েছিল টাই। সেবারও ম্যাচ শেষ হয়েছিল রান আউটে। এবং এবারের ফাইনালের মতোই টাই ম্যাচের ফলে উচ্ছ্বাসে ভেসেছিল এক দল, আরেক দলের ভেঙে গিয়েছিল হৃদয়!
ম্যাচ টাই হলেও আগের রাউন্ডে (সুপার সিক্স) পয়েন্ট টেবিলে দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে এগিয়ে থাকায় অস্ট্রেলিয়া উঠে গিয়েছিল ফাইনালে। সেই এগিয়ে থাকাও ছিল সামান্য ব্যবধানে। দুই দলেরই পয়েন্ট ছিল সমান। রান রেটে কেবল খানিকটা এগিয়ে ছিল অস্ট্রেলিয়া।
নাটকীয়তা বা উত্তেজনা, সব দিক থেকেই এবারের ম্যাচ ছাড়িয়ে গেছে সেই ম্যাচকে। মঞ্চ এবার আরও বড়, ক্রিকেট তীর্থ লর্ডসে বিশ্বকাপের ফাইনাল। ৩০ হাজার দর্শকে ঠাসা গ্যালারি। দুই দলের একটি স্বাগতিক দল, তাই আবহও অন্যরকম।
সেবার শেষ ওভারে ল্যান্স ক্লুজনারের দুটি বাউন্ডারির পরও শেষ পর্যন্ত পাগলাটে একটি রান আউটে জিততে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। এবার শেষ ওভারে ১৫ রানের সমীকরণে প্রথম দুটি বল ডট। পরের দুটি বল থেকেই এলো ৬ করে, যার একটি সীমানা পেরিয়েছে মাটি ছুঁয়ে!
ছক্কাটি ছিল দুর্দান্ত। ট্রেন্ট বোল্টের ফুল লেংথ স্লোয়ারকে স্লগ করে গ্যালারিতে ফেলেন বেন স্টোকস। পরের বল ফুল টস, স্টোকস খেললেন মিড উইকেট। স্ট্রাইক রাখতে দুই রান চাই-ই চাই। মরিয়া স্টোকস ছুটলেন। ফিল্ডার মার্টিন গাপটিল থ্রো করলেন। বল ছুটল স্টাম্পের দিকে। নিজেকে বাঁচাতে ডাইভ দিলেন স্টোকস। বল তার ব্যাটে লেগে ছুটে গেল বাউন্ডারিতে। দৌড়ে ২ এবং ওই চার মিলিয়ে ৬ রান! শেষ দুই বলে যখন প্রয়োজন ৩, দুটিতেই দুই রানের চেষ্টায় দুটি রান আউট। একটি করে রান হওয়ায় ম্যাচ টাই।
এজবাস্টনের ম্যাচকে ছাড়িয়ে যেতে হয়তো যথেষ্ট ছিল এটুকুই। কিন্তু নাটকীয়তার অনেক তখনও বাকি! ২০ বছর আগে সুপার ওভারের অস্তিত্ব না থাকলেও এখন এটি খুবই স্বাভাবিক। ম্যাচ গড়াল সুপার ওভারে। সেখানেও টাই, একই ম্যাচে দুইবার স্কোর সমান। এবং এবারও ম্যাচ টাই হলো শেষ বলে রান আউটে!
শেষ পর্যন্ত শিরোপার ফয়সালা হলো বাউন্ডারিতে, যেখানে এগিয়ে থেকে চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড।
এক ম্যাচেই দুই দফায় টাই, অবিশ্বাস্য নাটকীয়তা, দুই দলের ক্রিকেটারদের স্কিল, ফিটনেস ও মানসিক শক্তির চূড়ান্ত পরীক্ষা, একাত্ম হয়ে যাওয়া গ্যালারি, সব কিছু মিলিয়ে এই ফাইনাল অন্য সব ম্যাচকে পেছনে ফেলে দেওয়ার কথা খুব সংশয় ছাড়াই।
বর্তমান-সাবেক অনেক ক্রিকেটারের টু্ইটার প্রতিক্রিয়াও সাক্ষ্য দিচ্ছে এই ম্যাচের পক্ষে। ইংল্যান্ডের টেস্ট দলের পেসার ও সিনিয়র ক্রিকেটার স্টুয়ার্ট ব্রড লিখেছেন, “সাদা বলের ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা ম্যাচ।” সাবেক অফ স্পিনার ও এখনকার ধারাভাষ্যকার গ্রায়েম সোয়ানের কাছে, “জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠতম ম্যাচ।”
দুইবারের বিশ্বকাপ জয়ী, ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি ভিভ রিচার্ডস বলছেন, “ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচ।”
ওয়েন মর্গ্যানের কথার সুরও অনেকটা এ রকমই। সেরার তুলনায় না গেলেও ম্যাচ শেষে ইংল্যান্ড অধিনায়ক এটিকে বললেন সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ম্যাচ।
“আবেগ আমাকে যথেষ্টই ছুঁয়ে গেছে। এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, তাই আবেগটা যতটা সম্ভব ধরে রাখছি। এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, আমরা পেরে গেছি শেষ পর্যন্ত। অসাধারণ একটি দিন ছিল এটি। আপনারাও দেখেছেন, সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ক্রিকেট ম্যাচ, যেখানে দুই দলকে আলাদা করার মতো কিছুই ছিল না।”
“আমার মনে হয়, সূক্ষ্মতম ব্যবধান ছিল আজ এবং এটি যে কোনো দিকেই যেতে পারত। সৌভাগ্যবশত, আমাদের দিকে এসেছে।”
বিশ্বাস করতে, মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল কেন উইলিয়ামসনেরও। নিউ জিল্যান্ড অধিনায়ক মজা করে বললেন, কিভাবে একটি দল জিতল, বুঝেও উঠতে পারছেন না।
“একটি-দুটি দিকে যদি তাকাই, ব্যবধান এত সূক্ষ্ম ছিল যে ব্যাপারটি শেষ পর্যন্ত এমন জায়গায় গিয়েছে, যেখানে আমি জানি না... কিভাবে তারা জিতল? বাউন্ডারিতে বা এমন কিছুতে!(হাসি) কোনো একটি দলকে শিরোপা পেতেই হতো। আমি হতাশ যে সেই দলটি আমরা নই।”
২০ বছর আগের সেই সেমি-ফাইনাল নিয়ে যেমন কথা হয় এখনও, ইংল্যান্ড-নিউ জিল্যান্ড এই ফাইনাল নিয়েও নিশ্চিতভাবেই চর্চা হবে বছরে পর বছর। আসবে আরও অনেক ম্যাচ। যুক্তি-তর্কের খণ্ডন বা আলোচনা চলবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যে ৪ হাজার ১৯২ টি ম্যাচ দেখেছে ওয়ানডে ক্রিকেটে, এই ফাইনালের মতো কোনো ম্যাচ হয়নি, এটি নিশ্চিত।