খুলনা বিভাগে চার বছরে গড়ে উঠেছে ১১৪টি নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান
নিউজ ডেস্ক
210
প্রকাশিত: ০৮ জানুয়ারীফেব্রুয়ারি ২০২০
অব্যাহত লোকসানের কারণে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও খুলনা বিভাগে বেসরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠছে। গত চার বছরে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ১১৪টি ছোট, বড়ো ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ সময় নতুন শিল্প কলকারখানায় বিনিয়োগ হয়েছে ১৩ হাজার ২২৭ কোটি ৩৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এছাড়া নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ২১ হাজার ৫৪৯ জনের।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) অভিমত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা, চাহিদা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে খুলনা বিভাগে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্র জানায়, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের জুলাই মাস থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত খুলনা বিভাগের ১০ জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে ১১৪টি ছোট,বড়ো ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলায়।
সূত্রমতে, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে খুলনা বিভাগীয় বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ৩৭টি নতুন শিল্প কলকারখানার নিবন্ধন করা হয়। এ সব শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয় ৮৪৫৩.৩০৯৮ মিলিয়ন টাকা। এ সময় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় ৫ হাজার ৮৭৩জনের। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৩৪টি নতুন শিল্প কলকারখানার নিবন্ধন করা হয়। এ সব শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয় ১৩০৩৬.৭২৪৩ মিলিয়ন টাকা। এ সময় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় ৯ হাজার ৫৬২জনের। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ২২টি নতুন শিল্প কলকারখানার নিবন্ধন করা হয়। এ সব শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয় ১০৭৩৪৭.২০০ মিলিয়ন টাকা। এ সময় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় ৩ হাজার ৯০১জনের। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ১০টি নতুন শিল্প কলকারখানার নিবন্ধন করা হয়। এ সব শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয় ১৬৯২.৫৪৪ মিলিয়ন টাকা। এ সময় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় ৫৫৩ জনের। এছাড়া সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থ বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে ১১টি নতুন শিল্প কলকারখানার নিবন্ধন করা হয়। এ সব শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয় ১৭৪৩.৭৭৫০ মিলিয়ন টাকা। এ সময় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ২১ হাজার ৫৪৯ জনের। এদিকে, উক্ত চার বছরে খুলনা বিভাগে ১৫৩টি শিল্প কলকারখানার নিবন্ধন সংশোধন করা হয়েছে।
নতুন গড়ে ওঠা উল্লেখযোগ্য শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে, জুট অ্যান্ড টেক্সটাইল, এলপি গ্যাস, অটো রাইস মিল, মাছের হ্যাচারি ও হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, ফুড অ্যান্ড এলাইড প্রোডাক্টস, ক্যাটল, প্রোল্ট্রি অ্যান্ড ফিশ ফিড, প্রকৌশল শিল্প, রসায়ন শিল্প, ফার্মাসিউটিক্যাল, ফার্টিলাইজার, কোল্ড স্টোরেজ, প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, উড অ্যান্ড পার্টিকেল বোর্ড প্রসেসিং, ডক ইয়ার্ড শিল্প, সার্ভিস (সেবা শিল্প), ডেইরি প্রোডাক্টকস অ্যান্ড ডেইরি ফার্ম, অটোমেটিক ব্রিক ফিল্ড, প্লাস্টিক প্রোডাক্টকস, নির্মাণ শিল্প, পোল্ট্রি হ্যাচারি, পাওয়ার প্লান্ট এবং চামড়া ও ট্যানারি শিল্প ইত্যাদি। এদিকে গত চার বছরে যে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ১০টি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে, যশোরের নওয়াপাড়া শিল্প এলাকার এ রহমান জুট মিল, বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার নওয়াপাড়ার আলফা একসেসোরিজ লিমিটেড, খুলনা মহানগরীর লবণচরা এলাকার বেগম অটোরাইস মিল ইউনিট-২, মোংলার দুবাই বাংলা এলপি গ্যাস, কুষ্টিয়ার এইচ অ্যান্ড এস কুক ওয়্যার, জামান জুট মিল করপোরেশন, জয়তুন অটো রাইস অ্যান্ড ডাল মিল, এক্স আর ফ্লাক্সো প্যাক লিমিটেড, প্রগতি ফিস লিমিটেড ও রূপসা মিট অ্যান্ড অর্গানিক ফার্টিলাইজার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
খুলনার দিঘলিয়ার জামান জুট মিল লিমিটেডের অন্যতম অংশীদার (পার্টনার) কামরুজ্জামান বলেন, ২০১৭ সালে তাদের মিলটি নির্মাণ করা হয়। মিলটিতে বর্তমানে প্রায় ৩৫০জন শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। এই মিলের উৎপাদিত জুট ইয়ান বেশির ভাগ ভারতে রপ্তানি করা হয়। এছাড়া জুট ইয়ান দুবাইতেও রপ্তানি করা হয়।
তিনি জানান, বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মিলটি লাভজনক নয়। ব্যাংক লোনের অভাবের কারণে মিলটি চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে হলে সহজ কিস্তিতে ব্যাংক ঋণ ও সরকারি প্রণোদনা প্রয়োজন।
বাগেরহাটের গ্রিন বোর্ড অ্যান্ড ফাইবার মিল লিমিটেডের কো-অর্ডিনেটর শেখ গোলাম কিবরিয়া মিন্টু বলেন, তাদের মিলটি এখনো ট্রায়ালে রয়েছে। করোনার কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরোপুরি উৎপাদনে যেতে কিছুটা সময় লাগছে। তবে মিলটি লাভজনক হবে বলে তিনি আশা করছেন।
কুষ্টিয়ার এম ওয়াজি জুট মিল লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউর রহমান রমজান বলেন, ২০১৪ সালে তাদের মিলটি নির্মাণ করা হয়। এটি নির্মাণ করতে জায়গাসহ প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মিলটি লাভজনক। এই মিলের উৎপাদিত রাইস ব্যাগ ও পাটের সুতা ভারত ও চীনে রপ্তানি করা হয়। তিনি জানান, মিলটিতে বর্তমানে শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ৪৮০জন। প্রতি মাসে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনসহ খরচ হয় প্রায় ৪০ লাখ টাকা। করোনাকালের মধ্যেও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বকেয়া পড়েনি বলে দাবি করেন তিনি।
এদিকে, ক্রমাগত লোকসানের কারণে খুলনা বিভাগে অসংখ্য রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সর্বশেষ গত ২৫ জুন খুলনা অঞ্চলের নয়টিসহ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকল বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপর ২ জুলাই পাটকল বন্ধসহ গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় শ্রমিকদের অবসায়নের প্রজ্ঞাপন খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি জুট মিলের নোটিস বোর্ডে টানিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় প্রতিশ্রতি দেয়া হয় সংস্কার করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে চালু করা হবে। তবে, বন্ধ ঘোষিত মিল চালুর ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন (বিজেএমসি) সূত্র জানিয়েছে।
খুলনা অঞ্চলের বন্ধ হওয়া নয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল হচ্ছে- ক্রিসেন্ট জুট মিল, প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিল, খালিশপুর জুট মিল, দৌলতপুর জুট মিল, স্টার জুট মিল, ইস্টার্ন জুট মিল, আলিম জুট মিল, জেজেআই জুট মিল ও কার্পেটিং জুট মিল। মিলগুলো বন্ধ ঘোষণায় বেকার হয়ে যায় ৮ হাজার ১০০জন স্থায়ী শ্রমিক।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব শেখ আশরাফ-উজ জামান বলেন, খুলনা অঞ্চলে বেসরকারি উদ্যোগে শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠলেও অব্যাহত লোকসানের কারণে সরকারি মিল কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, মাথাভারী প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতি দায়ী। তিনি সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন ও বন্ধ মিল কলকারাখানা দ্রুত সংস্কার (বিএমআরই) করে অবিলম্বে চালুর দাবি জানান।
খুলনা বিভাগীয় বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তপক্ষের (বিডা) পরিচালক প্রণব কুমার রায় বলেন, মানুষের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে। তাছাড়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা, চাহিদা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণেও খুলনা অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও বিনিয়োগ বাড়ছে। এরফলে এ অঞ্চলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে। শত শত বেকার যুকক চাকরি পাচ্ছে। ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হচ্ছে।
তিনি বলেন, খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়া নতুন শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। আমাদের বিভাগে সবজি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ, গার্মেন্টস অ্যাকসেসোরিস উৎপাদনের শিল্প প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। যা দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে খুবই আশাব্যঞ্জক।
আরও পড়ুন:
অথনীতি সম্পর্কিত আরও
প্রচ্ছন্ন রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা চায় বিজিএপিএমইএ
১৩ জুন ২০২৪
ক্যাপিটাল গেইনে কর আরোপ প্রস্তাব থাকছেনা চূড়ান্ত বাজেটে
১২ জুন ২০২৪
ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা
১১ জুন ২০২৪
ইউরোপসহ ৩৮ দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের আম
১০ জুন ২০২৪
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবেন: অর্থমন্ত্রী
০৮ জুন ২০২৪
৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট পেশ আজ
০৬ জুন ২০২৪