ঢাকা বৃহস্পতিবার
২১ জানুয়ারীজানুয়ারী ২০২৪
০৬ জুন ২০২৪

অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি


নিউজ ডেস্ক
201

প্রকাশিত: ১৬ জানুয়ারীজানুয়ারী ২০২০
অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি



অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এখন ব্যক্তি খাতনির্ভর। অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। আলীহোসাইন আকবরআলী। তাঁকে বলা হয় বাংলাদেশের ইস্পাতশিল্পের গুরু। বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলের (বিএসআরএম) চেয়ারম্যান। এ দেশের লৌহ ও ইস্পাতশিল্পের যুগান্তকারী সব পরিবর্তনই এসেছে তাঁর হাত ধরেই। তিনি শুনিয়েছেন তাঁর জীবনের গল্প, বলেছেন সাফল্যের পেছনের কথা। সবে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি শেষ করেছেন। হাতে ছিল সৌদি আরবের সরকারি তেল কোম্পানি আরামকোতে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রস্তাব। পরিবারের ব্যবসা তখন ইস্পাত খাতে। ব্যবসা না চাকরি, কোনটাতে থিতু হবেন-এই চিন্তায় শেষমেশ পরামর্শ চাইলেন বাবার কাছে। বাবা জীবনের চাবি তুলে দিলেন তার হাতে, ‘তুমি জীবনের যে কোনো সময় চাইলে অ্যাকাউনট্যান্ট হতে পারবে, তবে ব্যবসায় থাকলে যে অভিজ্ঞতা হবে, তা জীবনে কখনো অর্জন করতে পারবে না।’ বাবার এই কথায় ১৯৭২ সালে মাসিক ২৫ হাজার রুপির চাকরির প্রস্তাব ফেলে আলীহোসাইন আকবরআলী যোগ দিয়েছিলেন পারিবারিক ব্যবসায়। শুধু যোগই দেননি, নিজের অক্লান্ত শ্রমে বাবা-চাচাদের হাতে গড়া ইস্পাত কারখানাকে নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়। হিসাববিদ্যায় পড়াশোনা করেও এ দেশের প্রকৌশল খাতের প্রতি বাংলাদেশে এখন এমন কোনো বড় ধরনের প্রকল্প নেই যেখানে বিএসআরএমের রড ব্যবহার হচ্ছে না। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, উড়ালসড়ক, কর্ণফুলী টানেলের মতো বড় প্রকল্পে ব্যবহার হচ্ছে বিএসআরএমের রড। এ দেশের লৌহ ও ইস্পাতশিল্পের যুগান্তকারী সব পরিবর্তনই এসেছে আলীহোসাইন আকবরআলীর হাত ধরে। ১৯৮৪ সালে উচ্চশক্তির ‘কোল্ড-টুইস্ট স্টিল রড’ দিয়ে ইস্পাতশিল্পে পণ্যের বৈচিত্র্য শুরু হয় তাঁর হাত ধরে। এরপর ৬০ গ্রেডের রড জনপ্রিয় করেন। আর ২০০৮ সাল থেকে তো ইস্পাত খাতে একের পর এক উচ্চশক্তির রড তৈরিতে যেন বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তাঁর দেখানো পথ ধরে অন্যরা উচ্চশক্তির রড বাজারজাত করেছে। ইস্পাতশিল্পের ইতিহাস ও বিকাশ দুটোতেই বারবার ওঠে এসেছে তাঁর নাম। ষ্ঠান ইস্পাতশিল্পের গুরু হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন।
এ দেশে ইস্পাতের ইতিহাস শুরু হয়েছে আজ থেকে ৬৮ বছর আগে, ১৯৫২ সালে। চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ শিল্প এলাকার কারখানায় আজকের বিএসআরএম গ্রুপের যাত্রা শুরুর সময়টাও একই। এই খাতে প্রথমে নেতৃত্ব দেন তাঁর বাবা আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালা। এরপর হাল ধরেন তিনি। এই সোনালি সময়টাও প্রায় ৪৩ বছরের। আলীহোসাইন আকবরআলীর সাফল্যের গল্প শুনতে যাই সদরঘাটে আলী ম্যানশনে বিএসআরএম গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে। তবে নিজের সাফল্যের গল্পে প্রচার চান না তিনি। ঘুরেফিরে পূর্বপুরুষ ও পরিবারের কথা, কর্মীদের কথা, দেশের উন্নয়নে ইস্পাতশিল্পের গুরুত্বের কথাই বেশি বললেন। বারবার প্রশ্ন করে তাঁর সাফল্যের নেপথ্যের গল্প উদ্ধার করতে হয়েছে। শুরুতে গল্পে গল্পে তিনি নিয়ে গেলেন গত শতাব্দীর তৃতীয় দশকে। ভারতের গুজরাটে। সেখান থেকে কখনো আফ্রিকার দেশ মাদাগাস্কার; কখনো পাকিস্তান, কেনিয়া; কখনো-বা হংকং। তবে মূল কেন্দ্রে রেখেছেন চট্টগ্রামকে, যেখানে সাফল্যের বীজ বপন করেছিলেন তাঁর বাবা ও চাচারা।

গুজরাট থেকে চট্টগ্রাম

আলীহোসাইনের পরিবারের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ভারতের গুজরাটের আম্রেলি জেলায়। গুজরাট প্রাচীনকাল থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের শহর। ব্যবসার প্রয়োজনে গুজরাটিরা সুরাট বন্দর দিয়েই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছেন নানা সময়। মহামন্দার সময় সুরাট বন্দর দিয়ে জাহাজে চেপে গুজরাটের বহু বণিক ছড়িয়ে পড়েন কেনিয়া, উগান্ডা, মাদাগাস্কারে মতো দেশে। এই দলে ছিলেন দাউদি বোহরা সম্প্রদায়ের আলীহোসেইনের দাদা আলীভাই খানভাই। ১৯২৯ সালে আফ্রিকার দেশ মাদাগাস্কারে গিয়ে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। বছর পাঁচেক পর আবার ফিরে আসেন গুজরাটে। চলতে থাকে ব্যবসা।
দেশভাগের সময় আলীহোসাইনের বাবা ব্যবসার কাজে ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। এবার নতুন ব্যবসায় হাতেখড়ি। আলীহোসাইন আকবরআলী জানালেন, ‘ঢাকার বেঙ্গল স্টিল থেকে বিমানে স্ক্রু নিয়ে করাচিতে বিক্রি করতেন বাবা। ১৯৫০ সালে তিনি বেড়াতে এলেন চট্টগ্রামে। এখানকার লৌহসমৃদ্ধ পানির স্বাদ ভালো লাগল তাঁর। চট্টগ্রামে জুবিলি রোডে বাসা ভাড়া নিয়ে হার্ডওয়্যারের ব্যবসা সম্প্রসারণ করলেন। বাণিজ্য থেকে লাভ হলো অনেক। লাভের টাকায় শিল্প গড়ার দিকে মনোযোগ দিলেন। যে লোহার পেরেকের বাণিজ্য করেছেন, তা-ই উৎপাদনের কারখানা দিলেন।

বিএসআরএমের শুরুর গল্প

দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে রড তৈরির কোনো কারখানা ছিল না। এ সময় বাংলার ১৮টি কারখানাই পড়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। তখনই চট্টগ্রামে ইস্পাতের মতো মাতৃশিল্প নির্মাণের পরিকল্পনা মাথায় আসে তাঁর বাবার। তাঁর চাচা তাহেরালী আফ্রিকাওয়ালা গেলেন কলকাতায়। কারখানা নির্মাণের জন্য কলকাতা থেকে একজন দক্ষ কারিগর আনা হলো। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা হলো দক্ষ শ্রমিক। ১৯৫২ সালে নাসিরাবাদে নির্মাণ হলো রড তৈরির কারখানা ‘ইস্ট বেঙ্গল রি-রোলিং মিলস’। ইস্পাত শিল্পের ইতিহাসও শুরু হলো। ষাটের দশকে (১৯৫২-৫৯) চারটি কারখানা তাঁদের পরিবারের হাতে আসে। রাশিয়ান লেখক এস এস বারানভ ‘পূর্ববাংলা: অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ষাটের দশকের শেষদিকে সম্প্রদায়ভিত্তিক যে বৃহৎ শিল্পপতি পরিবার ছিল, আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালা পরিবার তাদের অন্যতম।

চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা

ইস্পাত কারখানা চালুর তিন বছর আগে ভারতের গুজরাটের আম্রেলি জেলায় জন্ম হয় আলীহোসাইন আকবরআলীর। গুজরাটে জন্ম হলেও স্কুল-কলেজের পড়াশোনা চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় সেন্ট প্লাসিডস স্কুল থেকে ১৯৬৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। আগ্রাবাদের সরকারি কমার্স কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন।উচ্চমাধ্যমিকে কুমিল্লা বোর্ডে মেধাতালিকায় নবম স্থান অধিকার করেন তিনি। এরপর পাকিস্তানের করাচি চলে যান। সেখানে এসএম কলেজে সন্ধ্যাকালীন বিকম কোর্সে ভর্তি হন। আর দিনে করাচিতে এএফ ফারগুসানে চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্সি (সিএ) কোর্স করেন। ১৯৭২ সালেই কোর্স শেষ করেন। আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালার তিন সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট তিনি।

আরও পড়ুন:

বিষয়: