ঢাকা বৃহস্পতিবার
২১ জানুয়ারীজানুয়ারী ২০২৪
০৬ জুন ২০২৪

ব্যয় বৃদ্ধির চাপে মুনাফা কমেছে সিমেন্ট শিল্পে


নিউজ ডেস্ক
116

প্রকাশিত: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
ব্যয় বৃদ্ধির চাপে মুনাফা কমেছে সিমেন্ট শিল্পে



ডেক্স রিপোর্ট : কাঁচামাল ও সম্পূরক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বেশ চাপের মুখে রয়েছে দেশের সিমেন্ট খাত। এমনিতেই সিমেন্ট শিল্পে মুনাফা মার্জিন তুলনামূলক কম। তার ওপর উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে আরো কমছে মুনাফা। তবে ব্যয় বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এ খাতে। প্রতি বছরই বাড়ছে সিমেন্টের বাজার। ক্রমবর্ধমান বাজারে নিজেদের অবস্থান সংহত করতে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াচ্ছে সিমেন্ট খাতের কোম্পানিগুলো। এতে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে বাজার দখলের প্রতিযোগিতা। সম্প্রতি দেশের সিমেন্ট খাত নিয়ে ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেড প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ইবিএল সিকিউরিটিজের ওই প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৬ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সিমেন্ট তৈরির মূল কাঁচামাল ক্লিংকারের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। প্রতি টন ক্লিংকার আমদানিতে ১০ ডলার বাড়তি ব্যয় হচ্ছে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর। একই সময়ে জিপসামের দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৩ ডলার ও স্লাগের দাম বেড়েছে ৬ ডলার করে। তাছাড়া মহসড়কে ওজন স্কেলের কারণে বেড়েছে পরিবহন ব্যয়। সঙ্গে যোগ হয়েছে ঊর্ধ্বমুখী সুদহার। পাশাপাশি ফ্রেইট কস্ট ও বন্দরে পণ্য খালাসে দীর্ঘসূত্রতার কারণে ব্যয় বাড়ছে। এরপর অতিরিক্ত চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি ডলারের দাম ছিল ৭৮ টাকা ৭০ পয়সা। এর পর থেকেই ডলারের দাম বাড়তে থাকে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ডলারের দাম ৮৩ টাকা ৯০ পয়সায় দাঁড়ায়। আর সর্বশেষ গতকাল প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ১২ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। সিমেন্ট কারখানায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত কয়লার দামও ক্রমন্বয়ে বাড়ছে। ২০১৬ সালে ৩০ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৩২ শতাংশ ও ২০১৮ সালে ৬ শতাংশ বেড়েছে কয়লার দাম। এ কারণে কিছু কোম্পানি কয়লার পরিবর্তে প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলএনজি ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। সব মিলিয়ে কাঁচামালসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মুনাফা নিয়ে বেশ চাপের মুখে রয়েছেন সিমেন্ট উৎপাদকরা। সিমেন্ট তৈরিতে ৭৭ শতাংশ কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় ক্লিংকার। অন্যান্য কাঁচামালের মধ্যে আয়রন স্লাগ ৯ শতাংশ, ফ্লাই অ্যাশ ৭ শতাংশ, লাইমস্টোন ৪ শতাংশ ও জিপসাম ৩ শতাংশ ব্যবহার হয়। দেশে ক্লিংকারের চাহিদার ৮০ শতাংশই ভিয়েতনাম, চীন, হংকং, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা হয়। ফ্লাই অ্যাশের অধিকাংশই আসে ভারত থেকে। চীন, ভারত, জাপান ও সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি করা হয় স্লাগ। আর ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান ও ভারত থেকে আসে জিপসাম। বাংলাদেশের ক্লিংকার আমদানির প্রধান উৎস ভিয়েতনাম থেকে গত বছর ক্লিংকার আমদানি শুরু করে চীন। ফলে বাজারে ক্লিংকারের সংকট দেখা দেয়, যা এ কাঁচামালের দাম বাড়ার প্রধান কারণ। এদিকে ক্লিংকারের দাম বাড়ার কারণে বাড়তি ব্যয় সমন্বয়ের জন্য বেশকিছু কোম্পানি ক্লিংকারের ব্যবহার কিছুটা কমিয়ে অন্যান্য উপাদান বাড়িয়ে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ক্রাউন সিমেন্ট ক্লিংকারের ব্যবহার ৮১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭২ শতাংশে নিয়ে এসেছে। আর স্লাগের পরিমাণ ৭ থেকে বাড়িয়ে ১৬ শতাংশে উন্নীত করেছে। কাঁচামালের দামসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মুনাফাও কমছে সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর। শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭ সালে লাফার্জহোলসিম ১ হাজার ৮২ কোটি টাকার সিমেন্ট বিক্রি করেছে, যা আগের বছরে ছিল ১ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির উৎপাদন ব্যয় আগের বছরের ৬৯১ কোটি থেকে বেড়ে ৮২২ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে ২০১৭ সালে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা আগের বছরে ২২২ কোটি থেকে কমে ৮০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এক বছরে মুনাফা কমেছে ১৪২ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ৯৮০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে হাইডেলবার্গ সিমেন্ট। আগের বছর তাদের বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা। সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে কোম্পানিটির উৎপাদন ব্যয় হয়েছে ৭৮৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা ২০১৭ সালে ৮০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৭০ কোটি টাকা কম। ২০১৭-১৮ হিসাব বছর শেষে এমআই (ক্রাউন) সিমেন্টের বিক্রি ছিল ১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। যদিও আগের বছর ৯৪৪ কোটি টাকার সিমেন্ট বিক্রি করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৭-১৮ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির উৎপাদন ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৯২ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ৭৮৩ কোটি টাকা। ফলে ২০১৭-১৮ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ৩২ কোটি টাকা। যদিও আগের বছরে ৬৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল এমআই সিমেন্ট। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এমআই সিমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ খান বলেন, গত দেড় বছরে কাঁচামালের দর বৃদ্ধির পাশাপাশি লাইটার ভেসেলের সংকট, বন্দরের দীর্ঘসূত্রতা ও পণ্য পরিবহনে ওজন স্কেলের কারণে সিমেন্ট খাতের কোম্পানিগুলোর ব্যয় বেশ বেড়ে গেছে। এর ওপর যোগ হয়েছে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। সিমেন্ট খাত কাঁচামালের জন্য অনেকাংশে আমদানিনির্ভর। এ কারণে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে এ খাতের মুনাফা মার্জিন বেশ কমে গেছে। কিন্তু সিমেন্ট খাতে বাজার দখলে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে চাইলেই পণ্যের দাম বাড়ানো যায় না। ডলারের দর এখনো ঊর্ধ্বমুখী। ফলে সামনের দিনগুলোতেও ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি সিমেন্ট খাতের কোম্পানিগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলসের বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির উৎপাদন ব্যয় হয়েছে ৮৫৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৮৬৩ কোটি টাকা। বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে কোম্পানিটির মুনাফা হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা। যদিও আগের বছর ৫৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল প্রিমিয়ার সিমেন্ট। জানতে চাইলে প্রিমিয়ার সিমেন্টের কোম্পানি সচিব কাজী মো. শফিকুর রহমান বলেন, সিমেন্টের বাজার ধরার জন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। এ কারণে কোনো কোম্পানি একক সিদ্ধান্তে দাম বাড়ালে বাজার হারানোর ঝুঁকি থাকে। তাই ব্যয় বাড়লেও দাম সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছি। তবে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির কারণে দেশের সিমেন্টের বাজারের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান তিনি। ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে আরামিট সিমেন্টের বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৭২ কোটি টাকা, যা আগের হিসাব বছরে ছিল ১৫৬ কোটি টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির উৎপাদন খাতে ব্যয় হয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ১২৪ কোটি টাকা। ব্যয় বৃদ্ধির ফলে সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে ১৫ কোটি টাকা লোকসান করেছে আরামিট। যদিও আগের বছরেও ১০ কোটি টাকা লোকসানে ছিল প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে আরামিট সিমেন্টের কোম্পানি সচিব সৈয়দ কামরুজ্জামান বলেন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবহনসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যয় বাড়ার কারণে আমরা চাপের মুখে রয়েছি। তাছাড়া আমাদের দ্বিতীয় ইউনিটটি চালু করার কারণে যন্ত্রপাতির অবচয় বাবদ ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে সব মিলিয়েই লোকসান গুনতে হয়েছে আমাদের। তবে কাঁচামালসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি সত্ত্বেও দেশে সিমেন্টের বাজার ক্রমে বাড়ছে। সাত বছর ধরে দেশের সিমেন্ট খাতে গড়ে ১১ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আর ধারাবাহিক দুই অংকের প্রবৃদ্ধির কারণে ক্রমবর্ধমান বাজার ধরতে প্রতিযোগী কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন সক্ষমতাও বাড়াচ্ছে। যেখানে ২০১১ সালে দেশে সিমেন্টের উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২ কোটি ১৬ লাখ ৬০ হাজার টন, তা ২০১৮ সাল শেষে ৫ কোটি ১৪ লাখ ৭০ হাজার টনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিক্রির পাশাপাশি জনপ্রতি সিমেন্টের ব্যবহারও বেড়েছে। যেখানে ২০১১ সালে জনপ্রতি সিমেন্টের ব্যবহার ছিল ৯৪ দশমিক ৭৬ কেজি, ২০১৮ সালে এসে তা ১৮৪ কেজিতে উন্নীত হয়েছে। তবে জনপ্রতি সিমেন্ট ব্যবহারে বৈশ্বিক গড়ের (৫১৫ কেজি) চেয়ে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে রয়েছে। এমনকি প্রতিবেশী ভারত (৩১২ কেজি) ও মিয়ানমারের (২৭০ কেজি) তুলনায়ও বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে দেশের সিমেন্টের বাজার আরো বাড়ার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সিমেন্টের বাজার বিশ্বের মধ্যে ৪০তম। বিশ্বে মোট উৎপাদিত সিমেন্টের ৫০ শতাংশই চীনে। তবে সেখানকার বাজারের প্রবৃদ্ধির গতি বেশ শ্লথ। ওয়ার্ল্ড সিমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (ডব্লিউসিএ) প্রক্ষেপণ অনুসারে ২০১৯ সালে চীনে সিমেন্টের চাহিদা বাড়বে মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। তবে এ সময়ে এশিয়ায় বিশেষ করে ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশের বাজারে দুই অংকের প্রবৃদ্ধি হতে পারে।  সূত্র: বণিক বার্তা

আরও পড়ুন:

বিষয়: