ঢাকা বৃহস্পতিবার
২১ জানুয়ারীজানুয়ারী ২০২৪
০৬ জুন ২০২৪

জিডিপির অনুপাতে অর্থনীতি বড় হলেও, রফতানি আয় সংকুচিত হচ্ছে


নিউজ ডেস্ক
84

প্রকাশিত: ১৩ জানুয়ারীফেব্রুয়ারি ২০১৮
জিডিপির অনুপাতে অর্থনীতি বড় হলেও, রফতানি আয় সংকুচিত হচ্ছে



ডেক্স রিপোর্ট: অর্থনীতিকে শক্ত ভিত দেয় রফতানি আয়। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়ানোর প্রধান মাধ্যম এটি। আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রফতানি না বাড়লে ঘাটতি তৈরি হয় চলতি হিসাবে। এর প্রভাবে ঘাটতি দেখা দেয় ব্যালান্স অব পেমেন্টে। ফলে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয় অর্থনীতিতে। স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমে বড় হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। কিন্তু অর্থনীতির এ আকারের অনুপাতে বড় হচ্ছে না রফতানি খাত (ও রাজস্ব আয়)। বরং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে রফতানি আয় ও রাজস্ব আয়। পণ্য রফতানি বাবদ দেশের আয় এখন জিডিপির ১৫ শতাংশের কম। একটি মাত্র খাতনির্ভর রফতানি আয়কে এর অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা। পোশাক শিল্পনির্ভরতা বাংলাদেশের রফতানি খাতকে ক্রমেই ভঙ্গুর করে তুলছে। এ শিল্পের রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধিও আবার শ্লথ হয়ে পড়ছে। পোশাকের পর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য দ্বিতীয় শীর্ষ রফতানি খাত হলেও কয়েকটি বাজারেই তা সীমিত হয়ে আছে। পাটজাত পণ্যের বড় বৈশ্বিক বাজার তৈরি হলেও নানা সমস্যার কারণে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে দেড় দশক ধরে জিডিপির অনুপাতে রফতানি আয় ক্রমেই কমছে। দেশের জিডিপির অনুপাতে রফতানি আয়ের ক্রমহ্রাসমান চিত্র পাওয়া যায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বিশ্লেষণে। এতে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ১৯ হাজার ৫১৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার। অর্থবছরটিতে রফতানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১১৯ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। এ হিসাবে ওই অর্থবছর রফতানি আয় ছিল জিডিপির ১৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। পরের অর্থবছর এ হার কমে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৪৬ শতাংশে। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছর দেশের রফতানি আয় ছিল জিডিপির ১৩ দশমিক ৯৪ ও সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছর ১৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত অর্থবছর দেশের ২৭ হাজার ৪১১ কোটি ১০ লাখ ডলারের জিডিপির বিপরীতে রফতানি থেকে আয় হয়েছিল ৩ হাজার ৬৬৬ কোটি ৮১ লাখ ডলার। জিডিপির অনুপাতে রফতানি আয়ের এ সংকোচনকে অর্থনীতির জন্য উদ্বেগ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশে রফতানিভিত্তিক প্রবৃদ্ধির কৌশল গ্রহণের কথা বলা হচ্ছে। বাস্তবে পাঁচ-সাত বছর ধরে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। সাত বছর আগে আমাদের রফতানি আয় জিডিপির আনুপাতিক হারে বেড়েছে। অর্থনীতির ভাষায় একে বলা যায় ইনভার্সন, অর্থাৎ উপরের দিকে যাচ্ছিল, এখন আবার নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। কারণ আমরা যদি পূর্ব এশিয়ার দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে, তাদের অর্থনীতির মূল কাঠামো রফতানিভিত্তিক। এক্ষেত্রে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ড এবং সাম্প্রতিক সময়ে ভিয়েতনাম সবাই রফতানিভিত্তিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে এগোচ্ছে। ভিয়েতনামের রফতানি বাড়তে বাড়তে ২০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এ মডেলের সুবিধা হচ্ছে ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি হয় না। যদি রফতানি জিডিপির তুলনায় বাড়তে থাকে, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদও বাড়তে থাকে। এতে ক্যাপাসিটি টু সার্ভিস ডেট অর টেক ডেট শক্তিশালী থাকে। অন্যদিকে রফতানি জিডিপির তুলনায় কমলে সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে হয়ে পড়ে ভঙ্গুর। এখনো আমরা সে পরিস্থিতিতে যাইনি। তবে বিদ্যমান অবস্থা বেশি দিন চললে সেটা খারাপ লক্ষণ হিসেবেই বিবেচিত হবে। আমাদের দরকার রফতানি আয়ের ১৫-২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, যেটা আমরা গত কয়েক বছরে পাইনি। এর কারণে ইনভার্সনটা হচ্ছে। নন-পেট্রোলিয়াম পণ্যের বাইরের বিভিন্ন দেশের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জিডিপির অনুপাতে শক্তিশালী রফতানি আয় আছে অধিকাংশের। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ডাটা ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ভিয়েতনামের রফতানি আয় জিডিপির ১০১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এছাড়া মালয়েশিয়ায় এ হার ৭১ দশমিক ৪৭, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪৩ দশমিক শূন্য ৯, কম্বোডিয়ায় ৬০ দশমিক ৭৩ ও ইন্দোনেশিয়ায় ২০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের রফতানি আয় তাদের মোট জিডিপির ১৮ দশমিক ৮৭ ও শ্রীলংকার ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর বাংলাদেশের রফতানি আয় জিডিপির মাত্র ১৫ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। জিডিপির অনুপাতে রফতানি আয় বাংলাদেশের চেয়ে কম কেবল পাকিস্তানের, ৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। অর্থনীতি বড় হওয়ার পরও সে অনুপাতে রফতানি আয় না বাড়ায় চলতি হিসাবে ঘাটতি নিয়ে চলছে পাকিস্তান। একই সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে আর্জেন্টিনাকেও। লাতিন আমেরিকার অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশটির রফতানি আয় তাদের মোট জিডিপির মাত্র ১১ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি হিসাবে বড় ঘাটতিতে রয়েছে আর্জেন্টিনাও। সংকট কাটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের দ্বারস্থ হতে হয়েছে দেশটিকে। সংস্থাটি থেকে বড় অংকের ঋণ নিতে হয়েছে তাদের। বাংলাদেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক। মোট রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসছে এ খাত থেকে। যদিও পণ্য বৈচিত্র্যকরণের অভাব রয়েছে খাতটিতে। রফতানি করা পোশাকের ৮০ শতাংশই টি-শার্ট, ট্রাউজার, শার্ট, জ্যাকেট ও সোয়েটার। পাশাপাশি রফতানি বাজারও সীমিত। মোট পোশাক রফতানির ৭০ শতাংশই হচ্ছে মাত্র ১০টি দেশ— যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, জাপান ও চীনে। কয়েক বছর ধরে পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধিও শ্লথ হয়ে পড়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছর পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছর তা ৪ শতাংশে নেমে আসে। পরের অর্থবছর ঘুরে দাঁড়ালেও পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ ছাড়াতে পারেনি। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছর প্রবৃদ্ধি নেমে আসে ১ শতাংশের নিচে। তবে সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির দেখা পায় তৈরি পোশাক রফতানি খাত। ওভেন ও নিট— দুই ধরনের পোশাকপণ্য রফতানি হয় দেশ থেকে। নিট পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এটা ঠিক যে, রফতানি এখনো পোশাক খাতনির্ভর। এ পণ্যও আরো বৈচিত্র্যময় করার সুযোগ ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সরকারের খাতভিত্তিক নীতিসহায়তা নিশ্চিতের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে এ সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা অর্থনীতির স্বার্থেই প্রয়োজন। পোশাকের পরই বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রফতানি আয়ের খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। পণ্যটির রফতানি আয় বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। যদিও দুই দশক অতিক্রম করার পরও পণ্যটির রফতানি বাজার এখনো মাত্র তিনটি। জাপান, নেদারল্যান্ডস ও চীনের বাজারে সীমাবদ্ধ বাংলাদেশের চামড়াজাত ফুটওয়্যার রফতানি। এসব বাজার দখলেও ভিয়েতনাম ও ভারতের চেয়ে বেশ পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। চামড়াজাত ফুটওয়্যার রফতানি বাজার কেন এখনো সীমিত জানতে চাইলে লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সহসভাপতি মো. নাসির খান বলেন, জাপানে অনেক বছর আগেই রফতানি শুরু করি আমরা। কিন্তু বাজারটিতে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে আমাদের অবস্থান। ফুটওয়্যারের ক্রয়াদেশ এলে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রেই জাহাজীকরণ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। কিন্তু গ্লোবাল ভ্যালু চেইনের অংশ হতে হলে সঠিক সময়ে রফতানি হওয়া জরুরি। উৎসবের জন্য উৎপাদিত পণ্য উৎসব শেষে আর বিক্রি হয় না। এ কারণে আমাদের অনেক ক্রেতা এলেও পরে ফিরে গেছে। ক্রেতারা জানে, বাংলাদেশে ক্রয়াদেশ দিলে চলতি মৌসুমে বিক্রি হওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের আগে বাংলাদেশে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যের শুরুতে মূল পণ্য ছিল পাট। বাংলাদেশের কাঁচা পাট ছিল সারা বিশ্বে সমাদৃত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের পাট শিল্পের বৈশ্বিক সমাদর কমতে থাকে। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর অধিকাংশই লোকসানি। আর রফতানিনির্ভর বেসরকারি পাটজাত পণ্যের শিল্পগুলো আন্তর্জাতিক চাহিদা ওঠানামা, শুল্কারোপসহ বিভিন্ন সমস্যায় একের পর এক বন্ধ হচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছর পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি থেকে আয় হয় ১ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রফতানির মাত্র ২ দশমিক ৭ শতাংশ। রফতানি খাতের বৈচিত্র্য না থাকার পাশাপাশি খাতভিত্তিক নীতিসামঞ্জস্যহীনতা ও ক্ষেত্রবিশেষে নীতিবৈষম্যকে এর কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি রয়েছে সরকারি কার্যক্রমের প্রতিটি ধাপে দুর্নীতি। এসব কারণে রফতানি সম্ভাবনার পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের (বিএফটিআই) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলী আহমেদ বলেন, দেশের জিডিপি প্রতি বছরই বাড়ছে। জিডিপি যে হারে বাড়ছে, আনুপাতিক হারে বাড়ছে না রফতানি। এর মূল কারণ আমরা একটি মাত্র শিল্পে আটকে আছি। রফতানির ৮০ শতাংশের বেশি হচ্ছে পোশাক। এটা উদ্বেগের। কারণ একটি খাতকে কেন্দ্র করে এগিয়ে যাওয়ার একটি সীমা নিশ্চয়ই আছে। আমাদের রফতানি খাতকে বহুমুখী করতে হবে। নতুবা জিডিপিতে রফতানির অবদান কমতেই থাকবে এবং একটা সময় বড় পতন ঘটতে পারে। এলডিসি থেকে উত্তরণের অন্যতম সূচক ভালনারেবিলিটি বা ভঙ্গুরতা। এ সূচকে আমরা এখন উতরে যাচ্ছি। কিন্তু যেকোনো সময় পোশাক খাতনির্ভর রফতানিতে বড় ধরনের পতন আসতে পারে, যা আমাদের উন্নয়নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করতে পারে। তাই অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা ঠেকাতে রফতানিতে বৈচিত্র্য আনার বিকল্প নেই। সূত্র বণিক বার্তা

আরও পড়ুন:

বিষয়: