পিকে হালদারকে অর্থ আত্মসাতে সহযোগিতার ঘটনায় পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান (২০১৫-১৬) উজ্জ্বল কুমার নন্দীসহ দুইজনকে গ্রেফতার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারের অভিযোগ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন পি কে হালদার।
রোববার বিকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে। দুদকের পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টচার্য্য সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
তিনি জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফসিএল) চেয়াররম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হক।
অভিযোগ অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান তাদের গ্রেপ্তার করেন।
দুদক জানায়, পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অনুসন্ধানে এই দুইজনের নামে ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও অর্থপাচারের অভিযোগে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এই অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
এর আগে গত ২১ জানুয়ারি ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও পাচারের মামলায় পি কে হালদারের ব্যক্তিগত আইনজীবী সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধাকে গ্রেপ্তার করে দুদক। এরপর ওই দিনই তাদেরকে আদালতে হাজির করা হলে এই বাবা-মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।
এর আগে গত ১৩ জানুয়ারি পি কে হালদারের আরেক সহযোগী অবন্তিকা বড়ালকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। মামলার তদন্তে সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় এর আগে গত ৪ জানুয়ারি পি কে হালদারের আরেক ঘনিষ্ঠ সহযোগী শংখ ব্যাপারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে-পরে আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে অন্তত চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন।
কোম্পানিগুলো হল- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)।
এসব কোম্পানি থেকে তিনি ঋণের নামে বিপুল অংকের টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন বলে তদন্তকারীরা নিশ্চিত করেছেন।
প্রসঙ্গত, লিজিং কোম্পানির অর্থ লোপাটকারী প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) কানাডার টরেন্টোতে বিলাসী জীবনযাবন করছেন। সেখানে তিনি পাচার করা অর্থ দিয়ে বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। ওই দেশ থেকে তিনি মাঝেমধ্যে দুবাই ও ভারতে আসেন।
এখন তিনি দেশ দুটির কোনো একটিতে অবস্থান করছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।
আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুসহ সিন্ডিকেটের সহায়তায় কয়েকটি লিজিং কোম্পানি থেকে অন্তত ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা সরিয়ে পিকে হালদার দেশ থেকে সটকে পড়েন। এ অর্থের বড় একটি অংশ কানাডা, ভারত ও সিঙ্গাপুর পাচার করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা সরানো হয়। এছাড়া এফএএস ফাইন্যান্স, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং পিপলস লিজিং থেকে একই কায়দায় আরও প্রায় ৭৫০০ কোটি টাকা ঋণের নামে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে পিকে হালদার ও তার সিন্ডিকেট।
সব মিলিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এফএএস ফাইন্যান্স থেকে প্রায় ২২০০ কোটি টাকা, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে ২৫০০ কোটি টাকা, পিপলস লিজিং থেকে প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেখিয়ে আত্মসাৎ ও পাচার করা হয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ নেই বললেই চলে। ফলে ঋণ পরিশোধ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আর এর প্রধান কারিগর পিকে হালদার।
পিকে হালদার ২০০৮ সাল পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসিতে উপব্যবস্থাপনা (ডিএমডি) পরিচালক ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি হয়ে যান। এরপর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন। দেশ থেকে টাকা জালিয়াতির পর ২০১৮ সালে দুই ভাই মিলে ভারতে হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে কোম্পানি খোলেন। কলকাতার মহাজাতি সদনে তাদের কার্যালয়।
আর কানাডায় পিঅ্যান্ডএল হাল হোল্ডিং ইনক নামে কোম্পানি খোলা হয় ২০১৪ সালে। যার পরিচালক পিকে হালদার, প্রিতিশ কুমার হালদার ও তার স্ত্রী সুস্মিতা সাহা।